হিন্দুধর্ম প্রায় ২০,০০,০০০ বৎসর প্রাচীন একটি ধর্ম। তিন প্রধান দৈবপুরুষ, পৃথিবীতে ঈশ্বরের বাণীর প্রবক্তা ছিলেন। এরা হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। ব্রহ্মার জন্ম মধ্যভারতে, বিষ্ণু (যাঁর অপর নাম নারায়ন বা ভগবান বেঙ্কটেশ্বর বা ভগবান বালাজী) ছিলেন দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী এবং মহেশ্বর (যাঁর অপন নাম শিব/রুদ্র/শংকর) কাশ্মীর।
এই ত্রয়ীর দৈব-প্রবচন এত শক্তিশালী এবং তাঁদের দান এত বিশাল যে তাঁদের ঐশ্বরিক বাণীসমূহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ এবং অন্যান্য বহু দেশকেও প্রভাবিত করেছিল। সেই প্রাচীন যুগেও যখন যে-কোনও প্রকারের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অতি অনুন্নত, তাঁদের ঐশ্বরিক ঘোষণা দিকে দিকে বিস্তৃত হয়ে সনাতন ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠালাভ করে।
এই তিন ঈশ্বর পুরুষ আদি দেবতা নামে হাজার হাজার বছর ধরে শ্রদ্ধা পেয়ে আসছেন। এরাই এই সনাতন ধর্মের প্রবর্তক। পরবর্তীকালে এই ধর্মের নাম হয় হিন্দুধর্ম। এই তিন আদি দেবতার মাধ্যমে বেদ প্রকাশ হয়।
হিন্দুধর্মে কোনও একটি গ্রন্থের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এবং কোনও একটি মানুষকে এর প্রবর্তক বলে গণ্য করা হয় না। হিন্দুরা বেদকে বলেন অপৌরুষেয়ম্। পুরুষ অর্থাৎ মানুষের রচিত নয়, বেদ ঈশ্বরপ্রেরিত মনুষ্য জীবনযাপনের মূলমন্ত্র।
সিন্ধু নদেও পূর্ব তীরের সভ্যতাকে মধ্য এশিয়ার আক্রমনকারীরা হিন্দু বলত। তারা 'স-' এর উচ্চারণ করত 'হ' এবং সিন্ধু নদের পূর্ব তীরের অধিবাসীদের তারা বলত 'হিন্দু'।
প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মের আদি নাম ছিল সনাতন ধর্ম এবং তার প্রধান দর্শন বৈদিক ধর্ম অর্থাৎ বেদ প্রদত্ত ধর্ম। আক্রমণকারী এবং শাসক হিসাবে যারা ভারতে আসে তারা কালক্রমে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে মিশে যায় এবং হিন্দু দর্শনের মূলতত্ত্বসমূহ গ্রহণ করে। তাদের বিদেশী পরিচয় লুপ্ত হয়ে যায়।
হিন্দুদের আরাধ্য দেবতার নাম ঈশ্বর। ঈশ্বর এক পরম পুরুষ, সর্বব্যাপী, অনাদি-অনন্ত। তিনি নিরাকার, বর্ণহীন। তিনি সৃষ্টিকর্তা, সকল কারণের আদি কারণ। তিনি সর্বশক্তিমান, তাই তাঁর ইচ্ছাপালনের জন্য কোন অধীনস্থ সহায়কের প্রয়োজন নেই।
ঈশ্বর তাঁর মহত্ত্বের প্রতিফলন স্বরূপ দৈবপুরুষ অথবা দেবতাদের পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মানুষ রূপে প্রেরণ করেন। এঁদের কোনও কোনও ভারতীয় ভাষায় দেবতা বলা হয়।
ভক্তেরা ঈশ্বরের উপসনা করেন এবং মন্দিরে দেবতাদের জীবন, কীর্তি ও উপদেশাদি স্মরণ করে উৎসব পালন করেন। দেবতা অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ। তবে তাঁরা কীভাবে প্রকাশিত হবেন সেটা নির্ভর করে দেশ-কাল ও সামাজিক পটভূমিকার ওপর।
সাধারণ মানুষেরা মন্দিরে দেবতাদের মূর্তির কাছে যান। মূর্তি শুধুমাত্র ভক্তের পূজার পাত্র নয়, ঈশ্বরের ধ্যানের জন্য মূর্তি অখন্ড মনঃসংযোগের কেন্দ্রে পরিণত হন।
যিনি বেদ অধ্যয়ন করেছেন এবং অন্তরে তাকে সত্যরূপে উপলব্দি করেছেন, অর্থাঃ ধর্ম-দর্শনের গূঢ় তাৎপর্য যিনি অবগত হয়েছেন, মূর্তিপূজা তাঁর কাছে অনাবশ্যক। যিনি ঈশ্বরের প্রকৃত তত্ত্ব জ্ঞাত হয়েছেন।
মনে রাখতে হবে একমাত্র ঈশ্বরের উপাস্য। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান, সর্বশক্তিমান এবং পৃথিবী ও সৌরলোকের সীমার অতীত। তাঁর অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সকল মানুষ আসেন পূজার্চনা নিয়ে। যে নামেই পূজা হোক বা যে ভাবেই অর্চনা করা হোক, ঈশ্বর তা গ্রহণ করেন।
সনাতন ধর্মের ইতিহাসের আদিপর্বে হিন্দুরা একেশ্ববাদী ছিলেন, এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। তাঁরা মূর্তিপূজা শেখেন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারের চাকচিক্যময় নাগরিক সভ্যতা থেকে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার অধিবাসীরা সূর্যদেবতার, ভগবান শিবলিঙ্গের, মাতৃমূর্তির এবং কয়েকটি পশুপ্রতীকের পূজা করতেন।
মূর্তিপূজা মেসোপটেমিয় (মিশর) এবং সুমেরুরীয় (পারস্য) সভ্যতার প্রভাবের ফল। সে যুগে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে 'কিউনিফর্ম' লিপি ব্যবহার করা হত। কিউনিফর্মে অনেক মূর্তি চিহ্ন ব্যবহার হত। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর সভ্যতার চরম উন্নতি ঘটৈছিল খ্রীষ্টপূর্ব ১৪৭৫ এর পূর্বে। হিন্দু পূরাণের বর্ণনা অনুযায়ী ১৪৭৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সমূদ্রতলে এক প্রচন্ড ভূমিকম্প হয়। তার ফলে বিপুল জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়, যার দ্বারা সিন্ধুর তটভাগ প্লাবিত হয়। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো প্রভৃতি স্থান কর্দমে আবৃত হয়।প্রায় নিমেষের মধ্যে মানুষ, জীবজন্তু, বৃক্ষলতাদি বিনষ্ট হয়ে যায় এবং জল অপসৃত হওয়ার পরে এই সব সভ্যতা কর্দমের স্থূল আস্তরণের নিচে সমাধিস্থ হয়ে যায়।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারের নাগরিক সভ্যতায় গৃহ ও আসবাবপত্র নির্মাণের জন্যে প্রচুর কাঠের ব্যবহার হত। তার ফলে অরণ্যগুলি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অরণ্যের ধ্বংস প্রকৃতির অভিশাপ স্বরূপ হয়ে, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর বিলোপ ত্বরান্বিত করেছিল।
মূর্তিপূজা প্রকৃতপক্ষে দেবতার পূজা অর্থাৎ বীরপূজা। দেবতারা প্রকৃতপক্ষে মানুষ এবং সেই কারণে, এক অঞ্চলের দেবতা কখনও কখনও অন্য অঞ্চলে পূজিত হন না। তবে, যেভাবেই হোক এবং যে নামেই হোক, যে মাধ্যমেই শ্রদ্ধা নিবেদিত হোক, ঈশ্বর সে পূজা গ্রহণ করেন।
বেদের যুগে বর্ণভেদ ব্যবস্থা,শিশু বিবাহ কিংবা সতীদাহ প্রচলন ছিল না, যদিও শ্রমবিভাগ প্রচলিত ছিল। একই পরিবারের অর্ন্তভূক্ত বিভিন্ন সদস্য কেউ গুরু, কেউ শিক্ষক, কেউ যোদ্ধা অথবা কেউ কারিগর বৃত্তি অবলম্বন করতে পারতেন। বিভিন্ন বৃত্তির এবং পেশার মানুষেরা মধ্যে বিবাহ এবং এক বৃত্তি থেকে আরেক বৃত্তিতে প্রবেশ সাধারণ ঘটনা ছিল।
নারীও পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে বেদচর্চা করতেন। অপালা, ঘোষা, বিশ্ববরা, লোপমুদ্রা, বিশাখা প্রভৃতি নারীরা বৈদিকযুগের আদি পর্বে বৈদিক শাস্ত্রে বিদূষী হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর স্বামী নির্বাচনের এবং মতামত প্রকাশের অধিকার ছিল। শস্ত্র বিদ্যাতেও নারীরা পারদর্শীতা লাভ করতেন, যুদ্ধেও যোগদান করতেন। উদাহরণস্বরূপ, বৈদিক কালের এক যুদ্ধে একজন খ্যাতনাম্নী নারী সেনাপ্রধান ছিলেন মুদ্গলনি। নারীরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের স্বামীর সঙ্গিনী হতেন।
মূলতঃ হিন্দুরা একেশ্বরবাদী এবং এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে বিশ্বাসী। দক্ষিণ ভারতে ঈশ্বর দেবতে/ দেবাড়ু/ঈশ্বরণ/কাডাভু/
No comments:
Post a Comment