Saturday, May 6, 2017

তিতুমীর ও বাঁশের কেল্লার ভাঁওতা ১

ওয়াহাবির তাদের নিজেদের 'মুয়াহীদ' বা একেশ্বরবাদী অন্যদের বলে মুশরিক বা অংশীদার ওয়াহাবিদের মূল তত্ত্বগুলি হল:
1। তারা আল্লা হস্তপদ ইত্যাদি অঙ্গযুক্ত মনে করে না |
২। তারা মনে করে দ্বীনের প্রশ্নে যুক্তি-তর্কের কোনো স্থান নেই। দ্বীন সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর কোরান-হাদিস থেকেই সংগ্রহ করতে হবে|
3। আইন প্রণয়নের প্রশ্নে ঐক্যমতকে প্রত্যাহার করা উচিত। দ্বীনী রীতি নীতির সংগ্রাহক মত গ্রহণযোগ্য নয় যারা ওজে মতামতে বিশ্বাস করে তাদের ইসলামে অবিশ্বাসী বলে গণ্য করা হবে
4। সব ধরনের নাটকগুলি প্রত্যাহার করা উচিত
5। যেসব মুসলমান ওয়াহাবি মতবাদ শরীক নন তাদের গণ্য করা হবে ইসলামে অবিশ্বাসী বলে |
6। কোনও পীর-ফকিরকে সাথে সাথে হঠাৎ করেই তার সাথে যোগাযোগ করুন
7। পীর-ফকিরের মকবারা বা মাজার দর্শন অবৈধ |
8। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত বা ভজনা নিষিদ্ধ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে শপথ নেওয়াও নিষিদ্ধ পীর-ফকিরের মাজারে-মকবরাতে কোন ধরনের উৎসব নিষিদ্ধ
সৌদি আরবের ওয়াহাবিয়াবাদ এবং ভারতের সৈয়দ আহমদ বেরলবীর তরীকায় মুহাম্মাদিয়া আন্দোলন কোনও ফোরাম নেই। তাই বেরলবীর মতবাদে 'ভারতীয় ওহাবি আন্দোলন' বলে। হারলবীর, ভারতবর্ষে ওয়াহাবিবাদবাদ প্রচার এবং এই দেশকে 'দারুল ইসলাম' প্রতিষ্ঠা করার সময় বালাকোটের যুদ্ধে মারাত্মকভাবে তিনি নিহত হন | সৈয়দ আহমদ বেরলবী যখন হজ্বযাত্রার উদ্দেশে কলকাতা আসে তখন বহু বঙ্গবাসী মুসলমান তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই শিসের মধ্যে অন্যতম ছিল বারাসতে মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমির। পেশায় কুস্তিগার | নদীয়া একটি হিন্দু জমিদারের অধীনে লাঠিয়ালদের প্রধানদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারের কারাদণ্ড ভোগ করে। কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে জশোতে জেল থেকে বেরিয়ে সে বেরলবি 'রমিকায়ে মুহম্মদয়ায় যোগ দেন। এই তিতুমির পরবর্তীকালে শরিয়ত বিচ্ছিন্নতাবাদী ইসলামে ঢুকে পড়লো বাংলাদেশ লোকায়ত ইসলাম ও সমাজ জীবন।
তিতুমীর তার এলাকার তরীকায় মুহম্মদিয়া তথা বেরলবিব অনুসারী ওয়াহাবিদের সাথে দল গঠন স্থানীয় মুসলমানদের বাধ্য করা নাম পরিবর্তন করা, আরবীয়দের মত জব্বা পাট, লম্বা দাড়ি রাখা উনিশ শতকের শুরুতে বঙ্গদেশের সাধারণ গ্রামবাসী মুসলমানদের পরিধেয় ছিল ধুতি। তিতুমীর ফতোয়া জারি করে যে কাছা দিয়ে কাপড় পরা চলবে না কারণ কোরান-হাদিস কোথও ধুতির কথা উল্লেখ নেই! তাই ধুতি পরা বাদে !! তিনি আরো নির্দেশ দেন, গোঁফ ছিটে, দাড়ি রাখুন, কামা হব মাথার মাঝখানটা। ফতোয়া জারি করা, পুরোপুরি আরবি মুসলিমীয় নাম রাখা উচিত স্থানীয় মুসলমানদের পুরনো নাম পাল্টে নতুন নতুন আরবি নামের নাম দেওয়া হয়। সে সময় মুসলমান প্রজারা হিন্দু জমিদার ও তালুকদারদের বাড়িতে পূজা-পার্বণে ভেট পাঠিত। অনুষ্ঠানের পাতায় খিচুড়ি ও প্রসূন খেতো বিনা দ্বিধায়। তিতুমীর এই ভেট পাঠানো এবং হিন্দুদের ধর্মানুষ্ঠান খাওয়া দুটোই বন্ধ করার জন্য বলে। কারণ শরিয়ত অনুযায়ী একটি মুসলিম 'কেতাবি' খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের সঙ্গে একসাথে ভোজন করতে পারে, কিন্তু প্যাট্রিক হিন্দুদের আহার নিষিদ্ধ! হিন্দুদের তুলনায় খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য ছিল। তার কারণ খ্রিষ্টান-ইহুদিদের 'আসামানি কেতাব' (তওরাত, জবুর ও ইঞ্জিল) আছে, হিন্দুদের কোনও আকাশমণি কেতাব নেই! তাই হিন্দুদের সর্বাত্মকভাবে বর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের বিশ্বাসের দায়িত্ব !! তিতুমীর গ্রাম বাংলার সমৃদ্ধি আঠারোয়ান বিষাক্ত করে তুলল নষ্ট হয়ে তাতকালীন ধর্ম-সামাজিক ভারসাম্য ভীত হয়ে উঠল হিন্দুশমাজ বহু শতাব্দী ব্যাপী তুর্কি শাসন দুর্যোধন থেকে হিন্দুসমাজ তারপর সবে জেগে!
ইংরেজরা বিধর্মী যদিও মূলত সাম্রাজ্যবাদী সাম্রাজ্যের স্বার্থে তারা হিন্দুদের ধর্মশাস্ত্রে তেমন হস্তক্ষেপ করত না সেই সময়কালে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচার ছিল এবং সেখানে সরকারি সমর্থনও ছিল, কিন্তু তারা অন্তত গো-মাংস খাইবে হিন্দুদের জন্য মারবার জন্য দুর্বৃত্ত ছিল না !! হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে ভোলা বাজাতে না ফলে তিতুমীর কর্মকাণ্ডে বেশ ভাল থেকল না স্থানীয় জমিদারদের তারা আরো কট্টরপন্থী আওরঙ্গজেবের আবির্ভাব আশঙ্কায় আশঙ্কিত হয়ে গেছেন তিতুমীর আচার-আচরণে তারা শব্দও বিপদ গন্ধ পেল। জমিজমাতে এই নতুন বিভাজনপন্থীদের শায়েস্তা করার সুযোগ খোঁজা হয়েছিল। মুসলিমরা, যারা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া লৌকিক সংস্কারগুলি ছাড়াইতে, তারাও তিতুমিরের বিরক্ত হয়। তারা তিতুমীর কর্মকাণ্ড ভাল চোখে দেখে না | প্রমাণ সমসাময়িক সাহিত্য পাওয়া যায়:
'এই মুললুকেও সেই ওহাবী ফাছাদ
আসিয়া পৌঁছানো কত ঘনিষ্ঠ বিবাদ '
সূত্র: (আকবর-ই-পির-ই নজদ: আবদুল কাদির)
এরাই ইসলামিক জনতা হিরো!
সুত্র:
1। প্রাচীন ভারত ইতিহাস (দ্বিতীয় খণ্ড): সুনীল চাঁটফোড়ী
২। মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস (সুলতানী আমল) : অনিরূদ্ধ রায়
3। ভারতবর্ষ ও ইসলাম: সুরজিৎ দাশগুপ্ত
4। শাহ ওয়ালিউল্লা ও সামকালীন রাজনীতি: সৈয়দ আতহার আব্বাস রিজভী

No comments:

Post a Comment