দীপাবলী সনাতনধর্মীদের উৎসব বিশেষ. এটি দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়. মহালয়ায় শ্রাদ্ধগ্রহণের জন্য যমলোক ছেড়ে যে পিতৃপুরুষগণ মর্ত্যে আগমন করেন বলে, তাঁদের পথ প্রদর্শনার্থে উল্কা জ্বালানো হয়. এ কারণে ঐ দিন আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানো হয়. কেউ কেউ রাত্রিতে নিজগৃহে দরজা-জানালায় মোতবাতি জ্বালায়; কেউ বা লম্বা বাঁশের মাথায় কাগজের তৈরি ছোট ঘরে প্রদীপ জ্বালায়; একে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় আকাশপ্রদীপ. দীপাবলি মানে আলোর উৎসব. প্রতি বছরই দুর্গাপূজার আনন্দ-উচ্ছাস মিইয়ে যাবার আগেই দীপাবলি আসে. বিজয়ার ভাসানে- পাঁচদিনের আনন্দ-বিদায়ে অবচেতনে হলেও যে বিয়োগ-বিধূর চেতনায় আবিষ্ট হয় মন সেই মন দীপাবলিকে সামনে রেখেই আবার আনন্দের স্বপ্ন দেখে.
দীপাবলি- শুধু সনাতনধর্মীদের নয়, শিখ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও অনুষ্ঠান. আর এখন- এই অনুষ্ঠান সার্বজনীন; গ্লোভালাইজড সমাজে এখন একে আর সীমাবদ্ধ রাখা যায় না; এই অনুষ্ঠান আমার- আপনার- সবার; এদেশের- সেদেশের- ওই দেশের; এ জাতির- সে জাতির- ঐ জাতির. বাংলাদেশে দীপাবলি দিনে কালী পূজা হয়- তাই দীপাবলি আর কালী পূজা একসাথে গাঁথা. মালোয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল, গুয়ানা, ত্রিনিদাদ-টোব্যাগো, মারিশাস, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ফিজি এবং সুরিনামে দীপাবলী দিন, সরকারী ছুটির দিন.
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে দীপাবলীতে কালী পূজা হয়. অন্যান্য অঞ্চলে এই দিনে গণেশ পূজা এবং লক্ষ্মী পূজাও করা হয় .জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর 5২7 অব্দে দীপাবলী দিনে মোক্ষ (নির্বাণ) লাভ করেন. দীপাবলী দিনে শিখ ধর্মগুরু গুরু হরগোবিন্দ জী অমৃতসরে ফিরে আসেন; সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে গোয়ালিওর দুর্গ থেকে বায়ান্ন হিন্দু রাজাকে মুক্ত করে- তাঁর এই প্রত্যাবর্তনকে শিখগণ পালন করেন; তারা এই দিনকে 'বন্দী ছোড় দিবস'ও বলেন.
রামায়ন অনুসারে দীপাবলী দিনে ত্রেতা যুগে শ্রী রাম রাবণ বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন. শ্রী রামের চৌদ্দ বছর পরের প্রত্যাবর্তনে সারা রাজ্য জুড়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়. প্রজারা খুশীতে শব্দবাজি করে. অনেকে মনে করেন দীপাবলীর আলোকসজ্জা এবং শব্দবাজি ত্রেতাযুগে রাম-রাজ্যে ঘটে যাওয়া সেই অধ্যায়কে সামনে রেখেই অন্যসব অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছে, পরিচিত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে.
দীপাবলী মূলত পাঁচদিন ব্যাপী উৎসব. দীপাবলীর আগের দিনের চতুর্দশীকে (এই দিনকে দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিন বলা হয়) বলা হয় 'নরকা চতুর্দশী'; এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর স্ত্রী সত্যভামা নরকাসুরকে বধ করেছিলেন. চতুর্দশী পরের অমাবস্যা তিথি দীপাবলী উৎসবের দ্বিতীয় দিন, কিন্তু এই দিনই মূল হিসেবে উদযাপিত হয়. এই দিন রাতে শাক্ত ধর্মের অনুসারীগণ শক্তি দেবী কালীর পূজা করেন. তাছাড়া এই দিনে লক্ষীপূজাও করা হয়, কথিত আছে এই দিনে ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী বরধাত্রী রূপে ভক্তের মনোকামনা পূর্ণ করেন. বিষ্ণুপুরান মতে, বিষ্ণুর বামন অবতার অসুর বলিকে পাতালে পাঠান; দীপাবলী দিনে পৃথিবীতে এসে অন্ধকার ও অজ্ঞতা বিদূরিত করতে, ভালবাসা ও জ্ঞানের শিখা প্রজ্বলিত করতে অসুর বলিকে পৃথিবীতে এসে অযুদ অযুদ প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেওয়া হয়. দীপাবলীর তৃতীয় দিন- কার্তিকা শুদ্ধ; এই দিন অসুর বলি নরক থেকে বেরিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুর বরে পৃথিবী শাসন করে.চতুর্থ দিন হচ্ছে ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া; একে যম দ্বিতীয়াও বলা হয়; এই দিন বোনেরা ভাইকে নিমন্তণ করে, কপালে ফোটা দেয়, হাতে রাখী বেঁধে দেয়.
প্রত্যেক সার্বজনীন আনন্দের উৎসব মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর জয়কে উদযাপন করে. আলোকসজ্জার এই দিবস অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালার দিন. নিজের ভেতরের বাহিরের সকল অজ্ঞতা ও তমঃকে দীপ শিখায় বিদূরিত করার দিন. প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার চিরন্তন শিখা প্রজ্বলিত করার দিন. দেশ থেকে দেশে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে- এই দিনের মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন; তবু মূল কথা এক. আর আধ্যাত্মিকতার গভীর দর্শনে এই দিন- আত্মাকে প্রজ্বলিত করে পরিশুদ্ধ করে সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার দিন.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রসঙ্গে বলেছেন-
'' ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো
দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো
সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে ''. -
No comments:
Post a Comment